আমি মোঃ আহসান হাবীব। ১৯৮৬ সালে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন নীলডুমুর গ্রামে জন্মেছিলাম। ছোট বেলা থেকে সুন্দরবনের পাশেই বেড়ে ওঠা। একারণে সুন্দরবনের গাছ , প্রাণী এবং মধু সম্পর্কে আমার কিছুটা হলেও ধারণা আছে। আমার বাবা ও স্থানীয় এক জন সফল ব্যাবসায়ী ছিলেন। (এখন ব্যবসা করেন না). আমি মার্কেটিং এ বিবিএ এবং এমবিএ কমপ্লিট করে প্রায় ১০ বছর দেশীয় এবং মাল্টিন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানীতে কাজ করেছি। গত প্রায় এক বছর হলো ব্যবসা (নীলডুমুর ডট কম) করছি।
আমার বাবার নীলডুমুর বাজারে বড়ো চাউলের দোকান ছিল। ঝাউডাঙ্গা এবং খুলনা থেকে চাউল নিয়ে আসতেন। সাতক্ষীরার হোয়াইট গোল্ড খ্যাত চিংড়ি ঘের ছিল নিজেদের জমিতে। (২০০৯ সালের প্রলয়ংকরী আইলার পর থেকে আমার বাবা চিংড়ি ঘের করা ছেড়ে দেন)। এবং সুন্দরবন রিলেটেড ব্যবসা ও ছিল। আমার বাবা ও মধুর চালান দিতেন। তবে মধু এবং মাছ ধরা ছাড়া তৎকালীন সময়ে সুন্দরবনের ২ টা গাছ কাটারও পাশ/পারমিশন দেয়া হতো সরকারীভাবে। সুন্দরবনের গোলপাতা এবং গরান গাছ কাটার পাশ দেয়া হতো তখন। আমার বাবার এই ব্যবসাটা ও ছিল। তিনটা নৌকা ছিল গরান এবং গোলপাতা কাটার জন্য, যদিও ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে দুইটা নৌকা ডুবে যায়। বিগ সাইজের এই নৌকার দুইটা মডেল ছিলো , স্থানীয় ভাষায় এই নৌকাকে “বোলাবাড়ি নৌকা” এবং “বেতনাই নৌকা” বলা হত। তৎকালীন সময়ে সুন্দরবন এলাকায় প্রত্যেকটা বাড়ির চাল ছিল এই গোলপাতার ছাউনি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমাদের ঘর ও গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া ছিলো। গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া ঘরে গরম লাগে না , যেন প্রাকৃতিক এসি। গরান গাছের ২ টা পার্ট ছিলো এবং ব্যবহার ও হতো ২ জায়গায়। গরান গাছের নিচের অংশকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো “গরানের খাদি” এবং এই গরানের খাদি মূলত ইট ভাটা এবং রান্নার কাজে জ্বালানি কাঠ হিসাবে ব্যবহার হতো। গরানের উপরে অংশকে স্থানীয় ভাষায় “গরানের লগি / সিটি” বলা হতো এবং গরানের এই লগি বা সিটি পানের বরজে ব্যবহার হতো।
শীতের মৌসুমে গরান এবং গোলপাতার কাটার পাশ দেয়া হতো। পর পর ৩ টা ট্রিপ পাওয়া যেত। এক জন মাঝির নেতৃত্বে ৫/৬ জন বাওয়ালি যেত প্রত্যেক টা নৌকাতে। নৌকার মালিক তাদেরকে একটা মুজরি দিয়ে পাঠাতো। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই মুজরি নির্ধারণ হতো। যে নৌকা গোলপাতার পাশ নিত তাদের শুধু গোলপাতা কাটতে হতো এবং যে নৌকা গরানের পাশ নিতো তাদের গরানের খাদি অথবা গরানের সিটি কাটার সুযোগ থাকতো। তখন সুন্দরবনে জলদস্যূদের খুব উৎপাত ছিল। নৌকা থেকে কোনো এক জন কে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করতো। নৌকার মালিককে সেই মুক্তিপণ দিয়ে ওই বাওয়ালিকে ছাড়িয়ে আনতে হত। বড় নৌকার সাথে একটা মাঝারি সাইজের ডিঙি নৌকা যেত , কারণ সুন্দরবনের সব খালের ভিতর বড় নৌকা প্রবেশ করতে পারত না। ডিঙি নৌকাতে করে বাওয়ালীরা গোলপাতা / গরান কেটে এনে বড় নৌকাতে ভরতো। এছাড়াও জরুরি কোনও খবর অথবা কেউ অসুস্থ হলে ডিঙি নৌকাতে করে লোকালয়ে নিয়ে আসতো। তিনটা ট্রিপ শেষ হওয়ার অল্প কিছু দিন পর পহেলা এপ্রিল থেকে মধুর পাশ দেয়া হত। তখনকার দিনে যেদিন “মধু আহরণ উপলক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান” হতো ঐদিন ই অনুষ্ঠান শেষে সব নৌকা গুলো ছেড়ে যেত এবং কে কার আগে যাবে এ নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা হত। বড় নৌকার সাথে যে মাঝারি সাইজের ডিঙি নৌকা যেত ঐ ডিঙি নৌকাতে করেই মধু কাটতে যেত। আমার বাবাও মধুর চালান দিতেন সেই সময়ে। মৌয়ালরা মধু কেটে আনার পর আমার বাবা কিছু মধু স্থানীয় মার্কেটে বিক্রয় করতেন এবং বাকি মধু ঢাকাতে নিয়ে যেতেন। সেই সময়ের সুন্দরবনে পর্যাপ্ত মধু পাওয়া যেত , কোনও মৌয়ালি মধুতে ভেজাল দিতেন না। খুব গর্বের সাথে মৌয়ালীরা সুন্দরবনের বিখ্যাত চাকের মধু সংগ্রহ করে আনতেন। আমার বাবার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে #নীলডুমুরডটকম থেকে আবারও মধুর চালান দেব ইন্শাআল্লাহ এবং আমাদের প্রত্যেক সম্মানিত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেব সুন্দবনের ভেজাল মুক্ত চাকের মধু ইন্শাআল্লাহ।